শুল্ক আরোপ করে কী অর্জন করতে চাইছেন ট্রাম্প?
ডোনাল্ড ট্রাম্প, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী, পুনরায় শুল্ক নীতির প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। তিনি চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, যা বিশ্ব বাণিজ্যে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প এই শুল্ক আরোপের মাধ্যমে কী অর্জন করতে চাইছেন? এটি কি শুধুই একটি রাজনৈতিক কৌশল, নাকি এটি মার্কিন অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদী কোনো কৌশল?
ট্রাম্পের শুল্ক নীতির পটভূমি
প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন (২০১৭-২০২১) ট্রাম্প "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির অংশ হিসেবে চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং আমেরিকান শিল্পকে সুরক্ষা দিতে চীনের আমদানি পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেন।
২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে, ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে তিনি যদি পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তবে তিনি আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপ করবেন। বিশেষ করে চীনের উপর আরও কঠোর শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে তার।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের লক্ষ্য
১. আমেরিকান শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া
ট্রাম্পের মতে, উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে আমেরিকান কোম্পানিগুলো চীনের মতো সস্তা উৎপাদনকারী দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। এটি মার্কিন শিল্প এবং উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করবে।
২. আমেরিকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
শুল্কের কারণে বিদেশি পণ্যের দাম বেড়ে গেলে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে স্থানীয় কর্মসংস্থান বাড়বে।
৩. বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করা
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ট্রাম্প মনে করেন, শুল্ক আরোপের মাধ্যমে এই ঘাটতি কমানো সম্ভব।
৪. চীনের অর্থনীতিকে চাপে ফেলা
ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বাস করে, শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চীনের অর্থনীতি দুর্বল হবে এবং মার্কিন বাজারের উপর তাদের নির্ভরতা কমবে।
৫. রাজনৈতিক কৌশল ও নির্বাচনী প্রচারণা
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি কেবল অর্থনৈতিক কৌশল নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অস্ত্রও। তিনি তার সমর্থকদের কাছে এটি তুলে ধরছেন যে, তিনি আমেরিকানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়াই করছেন।
শুল্ক আরোপের সম্ভাব্য প্রভাব
১. পণ্যের দাম বৃদ্ধি
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে সাধারণ ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
২. মার্কিন ব্যবসার উপর নেতিবাচক প্রভাব
যেসব মার্কিন কোম্পানি চীনের সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা উচ্চ শুল্কের ফলে সমস্যায় পড়তে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান চীনের সস্তা কাঁচামাল ব্যবহার করে, যা ব্যয়বৃদ্ধির কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
৩. বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা বৃদ্ধি
বিশ্ববাজারে যদি যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, তবে অন্যান্য দেশও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
৪. চীনের প্রতিক্রিয়া
চীন যদি পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি, প্রযুক্তি এবং উৎপাদন খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ২০১৮-২০১৯ সালে বাণিজ্য যুদ্ধের সময় দেখা গেছে, চীন মার্কিন কৃষিপণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, যার ফলে অনেক মার্কিন কৃষক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।
অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিকোণ
অর্থনীতিবিদদের মতে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি স্বল্পমেয়াদে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর জন্য কিছু সুবিধা আনতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক খারাপ করতে পারে এবং মার্কিন অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামার্স বলেন, "ট্রাম্পের শুল্ক নীতি মার্কিন ভোক্তাদের জন্য ব্যয়বৃদ্ধির কারণ হতে পারে এবং এটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে।"
ডেমোক্র্যাটদের প্রতিক্রিয়া
ডেমোক্র্যাটরা এই পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বলছে, শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন ভোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
রিপাবলিকান দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কিছু রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদ এবং রিপাবলিকান নেতারা মনে করেন, উচ্চ শুল্ক আরোপ মার্কিন ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সমর্থকরা বলছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রকে আরও আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্ক নীতির প্রতি নজর রাখছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা এবং মেক্সিকোসহ বেশ কয়েকটি দেশ ট্রাম্পের শুল্ক নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
চীন ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, যদি ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট হন এবং উচ্চ শুল্ক আরোপ করেন, তবে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।
উপসংহার
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ নীতি একটি বিতর্কিত এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক কৌশল। যদিও এটি যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শিল্পকে সুরক্ষা দিতে পারে, তবে এটি মার্কিন ভোক্তাদের জন্য উচ্চ ব্যয়, আন্তর্জাতিক উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তবে তার শুল্ক নীতি কেবল মার্কিন অর্থনীতিতে নয়, পুরো বিশ্ববাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
.jpeg)