একজন পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হবেন না, শুধু এটাই সংস্কার?


প্রশ্ন তারেক রহমানেরঃ 

একজন পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হবেন না, শুধু এটাই সংস্কার?




 


রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একজন ব্যক্তি পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এমন একটি সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা চলছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যা রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার কমাতে সহায়ক হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, শুধুমাত্র এই সংস্কারই কি যথেষ্ট, নাকি আরও গভীরতর পরিবর্তনের প্রয়োজন?

প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশসহ অনেক দেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ একটি প্রধান সমস্যা। এক ব্যক্তি বা একটি দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, দুর্নীতি বাড়তে পারে এবং বিরোধী দলের জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র সংকুচিত হতে পারে। এসব বিষয় মাথায় রেখে, নতুন এই প্রস্তাব আনা হয়েছে যে, একজন ব্যক্তি টানা দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না

বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের নিয়ম রয়েছে। যেমন:

  • যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট দুবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারেন না।

  • রাশিয়াতে প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদের নিয়ম ছিল, যদিও পরে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।

  • ফ্রান্স ও মেক্সিকোতেও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

এই সংস্কারের মূল বিষয়বস্তু

এই সংস্কারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুটি টার্ম বা মেয়াদ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এর ফলে:

  1. একক আধিপত্য কমবে – দীর্ঘদিন ধরে একজন নেতা ক্ষমতায় থাকলে যে একনায়কতান্ত্রিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা কমবে।

  2. নতুন নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি হবে – তরুণ ও উদীয়মান নেতাদের সামনে আসার সুযোগ তৈরি হবে।

  3. রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাবে – দলীয় প্রধান পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন চিন্তাভাবনার উদ্ভব হবে।

  4. ক্ষমতার অপব্যবহার কমবে – দীর্ঘমেয়াদী শাসনের ফলে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়, তা কমার সম্ভাবনা থাকবে।

শুধুই কি এটুকু পরিবর্তন যথেষ্ট?

বিশ্লেষকদের মতে, শুধুমাত্র এই একটি পরিবর্তন আনলেই কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও উন্নত হবে? অনেকেই মনে করেন, ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন

১. নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার

  • স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও বাড়ানো দরকার

  • নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন।

  • ইভিএম বা ভোটিং প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।

২. সংসদীয় ব্যবস্থার ভারসাম্য

  • সংসদীয় গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে

  • সংসদ সদস্যদের ভূমিকা শক্তিশালী করতে আইনসভার কার্যকারিতা বাড়ানো দরকার।

  • দলীয় প্রধানের ক্ষমতা সীমিত করে গণতন্ত্রকে আরও বিকশিত করা প্রয়োজন

৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

  • বিচার বিভাগ যেন কোনো রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।

  • বিচারকদের নিযুক্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা দরকার।

  • আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য কার্যকর নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

৪. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা

  • সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোকে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

  • রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পদের হিসাবের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নতুন আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।

  • সরকারি প্রকল্প ও ব্যয়ের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত।

বিরোধী দল ও জনমতের প্রতিক্রিয়া

বিরোধী দলগুলোর মতে, এই আইন একটি ভালো উদ্যোগ হলেও এটি যথেষ্ট নয়। তাঁরা মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন, রাজনৈতিক পরিবেশের ভারসাম্য এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে শুধু প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত করলেই গণতন্ত্র সুসংহত হবে না

জনগণের মধ্যেও এই সংস্কার নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করবে, আবার অনেকে মনে করেন, এটি কেবলমাত্র একটি প্রতীকী পরিবর্তন

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলো এই পরিবর্তনকে গণতন্ত্রের পথে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। তবে তাঁরা আরও বলছেন যে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে আরও সংস্কার প্রয়োজন

উপসংহার

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন ব্যক্তির মেয়াদ দুইবারের বেশি না রাখার নিয়ম চালু করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এটি গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট কি না, সে বিষয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন। গণতন্ত্রকে টেকসই ও কার্যকর করতে আরও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ হয় এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষিত থাকে

Post a Comment

Previous Post Next Post