জাতীয় নির্বাচনের জন্য কী প্রস্তুতি লাগে ইসির



 

জাতীয় নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি

জাতীয় নির্বাচন একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি) উপর ন্যস্ত। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে নানাবিধ প্রস্তুতি নিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে আইনগত কাঠামো শক্তিশালী করা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা, নির্বাচন সামগ্রী বিতরণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা গ্রহণ।

আইনগত ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি

নির্বাচন কমিশনকে সর্বপ্রথম নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী আইনগত কাঠামো নিশ্চিত করতে হয়। সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (RPO), নির্বাচনী আচরণবিধি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় নির্বাচনের রূপরেখা নির্ধারিত হয়।

নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইসি নিম্নলিখিত কাজগুলো সম্পন্ন করে:

  1. নির্বাচন পরিচালনার বিধি প্রণয়ন ও পরিমার্জন: ইসি নির্বাচনী আইন পর্যালোচনা করে এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে সংশোধনী আনে।

  2. নির্বাচনী আচরণবিধি ঘোষণা: রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য আচরণবিধি নির্ধারণ ও তা কার্যকর করা হয়।

  3. প্রশাসনিক সমন্বয়: সরকারি প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বাচন পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়।

  4. মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই: প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ, যাচাই-বাছাই ও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়।

ভোটার তালিকা হালনাগাদ

ভোটার তালিকা একটি নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইসি নিয়মিতভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে যাতে নতুন ভোটারদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং মৃত বা অনুপস্থিত ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

ভোটার তালিকা তৈরির প্রধান ধাপগুলো হলো:

  1. নতুন ভোটার নিবন্ধন

  2. মৃত ও অনুপস্থিত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া

  3. নাগরিকদের তথ্য যাচাই ও সংশোধন

  4. চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ

নির্বাচন সামগ্রী প্রস্তুতি ও বিতরণ

নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন নির্বাচনী সামগ্রী প্রস্তুত ও বিতরণ করতে হয়।

  1. ব্যালট পেপার ছাপানো ও বিতরণ: ইসি নির্দিষ্ট মুদ্রণ কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ব্যালট পেপার ছাপানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

  2. ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) সরবরাহ: নির্ধারিত এলাকায় ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেশিন প্রস্তুত করা হয়।

  3. নির্বাচনী কেন্দ্র সাজানো ও সামগ্রী বিতরণ: ব্যালট বাক্স, সিল, কালির বোতল, ভোটার তালিকা ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা

নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

নির্বাচনী নিরাপত্তার প্রধান দিকগুলো হলো:

  1. বাহিনী মোতায়েন: পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।

  2. ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ: সহিংসতার ঝুঁকি থাকা কেন্দ্রগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়।

  3. প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা প্রদান: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

  4. নির্বাচনী অপরাধ দমন: ভুয়া ভোট, ভোট কেন্দ্রে গোলযোগ, অবৈধ প্রচারণা ইত্যাদি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা

নির্বাচন পরিচালনার জন্য ইসি সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে।

  1. প্রশিক্ষণ কর্মসূচি: প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

  2. ভোটার সচেতনতা কার্যক্রম: বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা হয়।

  3. গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষক সংস্থার ভূমিকা: নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও মিডিয়ার জন্য বিশেষ ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার

নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছে।

  1. ইভিএম প্রযুক্তির ব্যবহার: নির্দিষ্ট নির্বাচনী কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়।

  2. অনলাইন ভোটার তালিকা যাচাই: ভোটাররা অনলাইনে তাদের তথ্য যাচাই করতে পারে।

  3. রেজাল্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম: দ্রুত ও নির্ভুল ফলাফল প্রকাশের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

নির্বাচনের দিন পরিচালনা

নির্বাচনের দিন নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়।

  1. ভোট গ্রহণ ও পরিবহন: ব্যালট পেপার ও ইভিএম নিরাপত্তার সাথে কেন্দ্রে পৌঁছানো হয়।

  2. ভোট গ্রহণ পর্যবেক্ষণ: নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া তদারকি করেন।

  3. ফলাফল গণনা ও ঘোষণা: ভোট গণনা শেষে রিটার্নিং কর্মকর্তারা ফল ঘোষণা করেন।

উপসংহার

জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা একটি জটিল ও বহুস্তর বিশিষ্ট প্রক্রিয়া। নির্বাচন কমিশনকে এই নির্বাচনের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রতিটি পর্যায়ে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হয়। আইনি কাঠামো থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনাসহ প্রতিটি দিকের সুষ্ঠু সমন্বয়ই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post